ভারতের আসাম রাজ্যের কেন্দ্রে ব্রহ্মপুত্র নদী গর্ভে অবস্থিত, বিশ্বের বৃহত্তম নদী দ্বীপ মাজুলি,
Majoli ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্যগুলির সম্পর্কে প্রচুর বিস্ময়কর গল্প শোনা যায়। মনোরম উপত্যকা, প্রাণবন্ত সবুজের মেলা , ঘন বন এবং কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ের কথা , সব মিলিয়ে আমাদের মনে ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্য আসামের কথা মনে করিয়ে দেয়।
বিশ্বের বৃহত্তম নদীদ্বারা গঠিত আসাম রাজ্যে অবিস্থিতি এই, “মাজুলি”দ্বীপ। মনোরম দ্বীপটি ব্রহ্মপুত্র নদীর (Brahmaputra river) উত্তাল জলের উপরে আসামের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং ব্রাজিলের মারাজোকে পরাস্ত করে, বিশ্বের বৃহত্তম নদীর দ্বীপ হিসাবে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ, বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগৎ ছাড়াও যা মাজুলিকে একটি পর্যটন কেন্দ্র করে তোলে, তা হ’ল তার প্রাণবন্ত সংস্কৃতি। ব্রহ্মপুত্র নদের উত্থিত জলের দাপটে এই দ্বীপটির ল্যান্ডমাস বেশ খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও, এটি গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে, বিশ্বের বৃহত্তম নদীদ্বীপ হিসাবে রেকর্ড করা আছে।
মাজুলি হ’ল বিভিন্ন প্রজিতের উদ্ভিদ এবং প্রাণিকুলের জন্য হট স্পট, যেখানে শীতের মৌসুমে আগত পরিযায়ী পাখি সহ, অনেক বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর আশ্রয় স্থল। এখানে দেখতে পাওয়া পাখির মধ্যে বৃহত্তর অ্যাডজাস্ট্যান্ট স্টর্ক (adjutant stork), পেলিক্যান্(pelican), এবং সাইবেরিয়ান ক্রেন (Siberian crane) ইত্যাদি। শিল্প, কলকারখানা , পরিবেশ দূষণ,ও দীর্ঘকালীন বৃষ্টির অভাবে দ্বীপটি প্রায় দূষণমুক্ত।
“মাজুলি কথার অর্থ, দুটি সমান্তরাল নদীর মধ্যবর্তী একখণ্ড ভূমি” । মাজুলি দ্বীপের ক্রমাগত ভূমিক্ষয় এবং বন্যা, যা বিশ্বের বৃহত্তম নদী দ্বীপটিকে এর মূল আকারের থেকে অর্ধেকের ও কম করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা এখন পর্যন্ত যে প্রশ্নের শিকার হচ্ছে, সেটি হ’ল, ‘ব্রহ্মপুত্র কি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম নদী দ্বীপপুঞ্জকে খেয়ে ফেলবে’? এর অনুসন্ধান ও তথ্য অনুযায়ী, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে অতিরিক্ত ভূমি ক্ষয়ের কারণে 2030 সালের মধ্যে এই দ্বীপটি সম্পূর্ণ রূপে নির্চিন্ন হতে পারে। মূল কথাটি হল বৃহত্তম দ্বীপটি ভবিষ্যতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে ।
ব্রিটিশ আগমনের পর থেকে , ভারত স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত, সম্পূর্ণ মাজুলি ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। মাজুলীর স্থানীয় বাসিন্দারা মূলত অসমিয়া এবং মাইজিং ভাষা, ও কিছু সংখ্যক দেওরি ভাষায় কথা বলে।
শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের ভ্রমণের বর্ণনা দেওয়ার লিখিত রেকর্ডের ভিত্তিতে। ষোড়শ শতাব্দীতে মাজুলির সমাজ সংস্কারক হয়। মধ্যযুগীয় নব্য-বৈষ্ণব আন্দোলনের পথিকৃৎ শঙ্করদেব বৈষ্ণব নামক হিন্দুধর্মের প্রচার করেছিলেন এবং দ্বীপে সত্র হিসাবে পরিচিত মঠ ও আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই দ্বীপটি বৈষ্ণবীনিস্ম কেন্দ্র হয়ে উঠে।
কার্যত মাজুলি দ্বীপের বাসিন্দারা শ্রীকৃষ্ণের জীবনকে চিত্রিত করে তিন দিনের দীর্ঘ রাস উৎসব পালন করে। শত শত কিলোমিটার দূরে থাকা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বেশ কিছু প্রবাসী সদস্য এই উৎসব পালন করতে মাজুলি আসেন।মাজুলি দ্বীপের আরেকটি বড়ো উৎসব, আলি আয়ে লিগাংয়ের (Ali aye ligang) উৎসবটি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি দ্বিতীয় বুধবার থেকে পরের সপ্তাহ পর্যন্ত অনুষ্টিতো হয়, যা বিরাট আড়ম্বরের সহিত পাঁচ দিন ধরে পালিত হয়।
মাইজিং গোত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টানরা, মাজুলি দ্বীপের, অন্যানো উৎসবের মতো বড়দিন ও পালন করে থাকে। যেখানে জেনগ্রাইমুখ গ্রামটি(Jengraimukh village) খ্রিস্টানদের কেন্দ্রস্থল। মাজুলিতে গত ৫০০ বছর ধরে, অসমিয়া সভ্যতা সাংস্কৃতিকর আড়ম্বর চলে আসছে । যেমন প্রাচীন জিনিসপত্র অস্ত্র, বাসন, গহনা এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক তাৎপর্য সংরক্ষণ করে। যাদের সংস্কৃতি এবং নৃত্যের রূপটি আধুনিকতাবাদ থেকে অস্পষ্ট। এই উপজাতির হাতের তৈরি -তাঁতের কাজ আন্তর্জাতিক মহলে বিখ্যাত।
বর্তমানে দ্বীপটি বিস্তৃত মাটি ক্ষয়ের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে। বেশিরভাগ অঞ্চলই ভূমিধসের কবলে যা ব্রহ্মপুত্রের ক্রোধের একটি প্রতিক্রিয়া।একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ১৮৫৩ সালে মাজুলির মোট আয়তন ছিল ১,১৫০ কিলোমিটার এবং এখনো পর্যন্ত এই ল্যান্ডমাসের করোনা প্রায় ৩৫% ভূমি ক্ষয় হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে ৩৫ টিরও বেশি গ্রাম ভূমিধসের কবলে পরে ভেসে গেছে। জরিপ অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে মাজুলির অস্তিত্ব থাকবে না।
দ্বীপটিকে ভূমিধসের কবলে থেকে বাঁচাতে ভারত সরকার ২.৫০ বিলিয়ন ডলার মার্কিন ডলার বরাদ্দ করেছে। জলসম্পদ বিভাগ এবং ব্রহ্মপুত্র বোর্ড বিগত তিন দশক ধরে এই দ্বীপের ক্ষয় সমাধানের জন্য লড়াই করছেন। তবে খুব বেশি সাফল্য পায়নি। ব্রহ্মপুত্র নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পটি এখনও সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তবে মাজুলিকে বিশ্ব ঐতিহাসিক স্থান হিসাবে ঘোষণা করার জন্য ইউনেস্কোর কাছে একটি মনোনয়ন পাঠানো হয়েছে।